সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬

আল্লাহর রাস্তায় একটি আমলে ৪৯ কোটি গুণ বা বে হিসাব সওয়াব হবে যেভাবে

আল্লাহর রাস্তায় একটি আমলে ৪৯ কোটি গুণ বা বে হিসাব সওয়াব হবে যেভাবে ...
১ম হাদীস
عن خريم بن فاتك : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من أنفق نفقة في سبيل الله كتبت له بسبع مائة ضعف
অনুবাদ-হযরত খুরাইম বিন ফাতেক রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় কোন কিছু খরচ করে তা তার আমলনামায় ৭ শত গুণ হিসেবে লেখা হয়।
সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-১৬২৫
সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৪৬৪৭
সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস নং-৪৩৯৫
মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯০৩৬
মুসনাদে তায়ালিসী, হাদীস নং-২২৭
মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-১৯৭৭০
শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩২৯৪
এখালে লক্ষ্য করুন। এক টাকা খরচ করলে এখানে সাত শত গুণ সওয়াব লেখার কথা এসেছে। এবার দ্বিতীয় হাদীসটি দেখুন-
২য় হাদীস
عن سهل بن معاذ عن أبيه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال إن الذكر في سبيل الله تعالى يضعف فوق النفقة بسبع مائة ضعف قال يحيى في حديثه بسبع مائة ألف ضعف
হযরত সাহল বিন মুয়াজ রাঃ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহকে স্মরণ করার সওয়াব আল্লাহর রাস্তায় খরচের সওয়াবের তুলনায় ৭ লক্ষ গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।
অন্য বর্ণনায় এসেছে সাত লক্ষ গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।
মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৫৬১৩
আল মু’জামুল কাবীর, হাদীস নং-৪০৫
মুসনাদুস সাহাবা ফি কুতুবিত তিসআ, হাদীস নং-১৫১৮৬
কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল, হাদীস নং-১০৮৭৯
জামেউল আহাদীস, হাদীস নং-৬৮৫৮
এবার উভয় হাদীসকে একত্র করুন। প্রথম হাদীস দ্বারা জানতে পারলাম। এক টাকা খরচে সওয়াব পাওয়া যায় ৭ শত গুণ। আর দ্বিতীয় হাদীসে জানতে পারলাম খরচের তুলনায় অন্য আমলে পাওয়া যায় ৭ লক্ষ্য সওয়াব বেশি। এর মানে হল, একটি আমল করলে প্রতি আমলে খরচ করলে যত পাওয়া যেত তারও সাত লক্ষ্য গুণ বেশি সওয়াব।
তাই এবার ৭ শতকে ৭ লক্ষ্য দিয়ে গুণ দিন। ৭০০×৭০০০০০=৪৯,০০,০০,০০০।
তাহলে কি বুঝা গেল? আল্লাহর রাস্তায় একটি আমল করা ঊনপঞ্চাশ কোটি আমল করার সওয়াবের সমতূল্য।
উল্লেখিত হাদীস দু’টি সনদ হিসেবে দুর্বল। কিন্তু জাল নয়। আর সকল গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিসগণ একমত দুর্বল হাদীস ফযীলতের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। তাই এ ফযীলত বলতে কোন সমস্যা নেই।
***************
মুহাদ্দিসীনে কেরামের মূলনীতি হল দুর্বল হাদীস ফাযায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। যেমন-
সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকার ইমাম নববী রহঃ বলেন-
قال العلماء من المحدثين والفقهاء وغيرهم يجوز ويستحب العمل فى الفضائل والترغيب والترهيب بالحديث الضعيف ما لم يكن موضوعا (الأذكار-7-8
মুহাদ্দিসীন ও ফুক্বাহায়ে কেরাম এবং অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম বলেন-দুর্বল হাদীসের উপর ফাযায়েল ও তারগীব তথা উৎসাহ প্রদান ও তারহীব তথা ভীতি প্রদর্শন এর ক্ষেত্রে আমল করা জায়েজ ও মুস্তাহাব। যখন উক্ত হাদীসটি জাল না হয়। {আল আজকার-৭-৮}
এ মূলনীতিটি নিম্ন বর্ণিত বিজ্ঞ ব্যক্তিগণও বলেছেন-
১- মোল্লা আলী কারী রহঃ-মওজুয়াতে কাবীর-৫, শরহুন নুকায়া-১/৯
২- ইমাম হাকেম আবু আব্দুল্লাহ নিশাপুরী রহঃ-মুস্তাদরাকে হাকেম-১/৪৯০
৩- আল্লামা সাখাবী রহঃ- আল কাওলুল বাদী’–১৯৬
৪- হাফেজ ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী রহঃ- মাজমুআ ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়া-১/৩৯
আহলে হাদীস নামধারী গায়রে মুকাল্লিদগণও এ মূলনীতিতে একমত
১- শায়খুল কুল মিয়া নজীর হুসাইন সাহেব দেহলবী রহঃ- ফাতওয়া নজীরিয়া-১/২৬৫
২- নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান- দলীলুত তালেব আলাল মাতালিব-৮৮৯ {নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেবকে গায়রে মুকাল্লিদদের আকাবীরদের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে ধর্তব্য করা হয়। {আপকি মাসায়েল আওর উনকা হল কুরআন ওয়া সুন্নাত কি রওশনী মে, লেখক-মুবাশশির আহমাদ রাব্বানী-২/১৮১}
৩- মাওলানা সানাউল্লাহ ওমরতাসরী রহঃ- আখবারুল হাদীস-১৫ শাওয়াল ১৩৪৬ হিজরী।
৪- হাফেজ মুহাম্মদ লাখওয়ী রহঃ- আহওয়ালুল আখরাস-৬
৫- মাওলানা আব্দুল্লাহ রূপরী সাহেব রহঃ- ফাতওয়া আহলে হাদীস-২/৪৭৩
শায়েখ জাকারিয়া রহঃ ও এ মূলনীতির কথা বলেছেন-
“এ বিষয়ে সতর্ক করাও জরুরী যে, হযরত মুহাদ্দিসীন রাঃ গণের নিকট ফাযায়েলের বর্ণনায় অনেক সুযোগ আছে। আর মামুলী দুর্বলতা গ্রহণযোগ্য। তবে সুফীয়ায়ে কেরামের ঘটনাতো ঐতিহাসিক বিষয়। আর এটা জানা কথা যে, ঐতিহাসিক বিষয় হাদীসের মর্যাদার তুলনায় খুবই কম। {ফাযায়েলে আমাল, উর্দু এডিশন-৩৮৪, রেসালায়ে ফাযায়েলে নামায, তৃতীয় অধ্যায়, ফাযায়েলে আমাল পর ইশকালাত আওর উনকা জাওয়াব নম্বর-৬৫, ফাযায়েলে দরূদ-৫৬}
নোট
হযরত শায়েখ জাকারিয়া রহঃ যদি কোথাও দুর্বল হাদীস বর্ণনাও করেছেন, সেখানে সাথে সাথে আরবীতে লিখে দিয়েছেন যে, এ হাদীসটি দুর্বল।
শায়েখতো অনেক হেকমত ও দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন এ ব্যাপারে। কারণ হাদীস সহীহ দুর্বল বলাটা এটা বিজ্ঞ ওলামাদের কাজ। তাই তিনি এসব যারা বুঝেন তাদের জন্য আরবীতেই বিষয়টি পরিস্কার করে দিয়েছেন, উর্দুতে তা আর অনুবাদ করেন নি। কারণ যার কাজ তাকেই সাজে, অন্যরা করতে গেলেই সমস্যা বেঁধে যায়। যেমন বর্তমান জমানায় অনুবাদ পাঠকরাও হাদীসের সহীহ জয়ীফ নিয়ে মন্তব্য করে হাদীসকে হাস্যকর ও জগাখিচুরী পাকিয়ে ফেলছে।
ফেতনা রুখার জন্যই শায়েখ হাদীসের সহীহ জয়ীফ হওয়ার কথা আরবীতে বলেছেন। উর্দুতে অনুবাদ করেন নি। হযরাতের ভাষ্য অনুযায়ী এটাও বুঝা যায় যে, হযরত ফাযায়েলে আমালে খুব কম হাদীসই দুর্বল এনেছেন।
যে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসীনরা স্বীয় কিতাবে ফাযায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস এনেছেন
১- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ স্বীয় কিতাব “আস সুন্নাহ” এর মাঝে ৩০৩টি।
২- ইমাম বায়হাকী রহঃ “কিতাবুল আসমাই ওয়াস সিফাত” গ্রন্থে ৩২৯টি।
৩- ইবনে তাইমিয়া রহঃ তার “আল মুনতাকা” গ্রন্থে ২৬২টি।
৪- হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ তার “বুলুগুল মারাম মিন আদিল্লাতিল আহকাম” গ্রন্থে ১১৭টি।
৫- ইমাম নববী রহঃ তার খুলাসাতুল আহকাম মিন মুহিম্মাতিস সুনান ওয়া কাওয়ায়িদিল ইসলাম” গ্রন্থে ৬৫৪টি।
৬- মুহাম্মদ ইবনে খুজাইমা রহঃ তার “কিতাবুস সিহাহ” গ্রন্থে যা সহীহ ইবনে খুজাইমা নামে প্রসিদ্ধ এনেছেন-৩৫২টি।
৭- মুহাম্মদ ইবনে হিব্বান রহঃ তার “কিতাবুস সিহাহ” যা সহীহ ইবনে হিব্বান নামে প্রসিদ্ধ, তাতে এনেছেন-২৯৪টি।
৮- ইমাম দারা কুতনী রহঃ তার “সুনানে দারা কুতনী” তে অনেক দুর্বল হাদীস এনেছেন বলে মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন।
৯- গায়রে মুকাল্লিদদের ইমাম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খানও তার “কিতাবু নুজুলিল আবরার” নামক গ্রন্থে ১৩৩টি দুর্বল হাদীস এনেছেন।
*****************
আজকাল আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ আলেম আর গায়রে আলেমের মাঝের পার্থক্য জানে না। হাস্যকর ব্যাপার হল-দু’ একটি বাংলা বা ইংরেজী ভাষায় হাদীসের কিতাব ও কুরআনের অনুবাদ পড়েই এখন অনেকে আল্লামা সেজে যাচ্ছেন। কিছু কিতাবের অনুবাদের রেফারেন্স মুখস্ত করে একের পর রেফারেন্স দিতে পারলেই আমাদের সমাজের সাধারণ লোকেরা বড় আল্লামা বানিয়ে দিচ্ছে লোকটিকে। লোকটির মাঝে আরবী বুঝার ক্ষমতা আছে কি না? অনুবাদ ছাড়াই মূল কিতাব থেকে মাসআলা বের করার যোগ্যতা আছে কি না? কুরআনের আয়াতের শানে নুজুল, শব্দের অলংকার, আরবী ব্যাকরণ, নাসেখ-মানসুখ, শানে ওরুদ, তাফসীর ইত্যাদী সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখে কি না? ইত্যাদি যাচাই করা ছাড়াই অনুবাদের রেফারেন্সদাতাদের যে সমাজ আল্লামার মর্যাদা দিতে শিখে। সে সমাজের লোকেরা আলেমদের কাছে কেন যাবে?
আলেমদের কাছে না যাওয়ার কারণে। যারা কুরআন সুন্নাহকে মূল কিতাব থেকে, তার নাসেখ-মানসূখ, শানে ওরুদ ও শানে নুজুল, তাফসীর ইত্যাদিসহ মাসায়েল বর্ণনা করেন, ব্যাখ্যা দেন, তাদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ না করা আমাদের সমাজে বিভ্রান্তির মূল কারণ।
নিজে নিজেই কিছু অনুবাদ পড়ে আল্লামা সাজার প্রবণতা ইদানিংকালে বেড়ে গেছে। কোন কিতাবের অনুবাদ পড়ে বুঝতে না পারলে, বা কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে নিজে নিজেই এর সামাধান খুঁজে। না পেলে প্রচার করতে শুরু করে কিতাবটি ভুল। শিরকে পূর্ণ। আদৌ কি বিষয়টি এমন কিনা? কোন বিজ্ঞ আলেম থেকে তা জেনে নেবার প্রয়োজনীয়তা বোধ না করায় গোমরাহ হচ্ছে এ সমাজের অনেক নতুন প্রজন্ম।
অষুখ হলে বিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে না গিয়ে নিজে নিজে চিকিৎসা করাকে কেউ নিরাপদ না মনে করলেও,
বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ইঞ্জিনিয়ারের কাছে না গিয়ে নিজে নিজেই নির্মাণ শুরু করাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেও, আজকের সমাজের মানুষেরা কুরআন সুন্নাহের মত স্পর্শকাতর বিষয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের শরনাপন্ন হওয়া ছাড়া নিজে নিজেই সব শিখে নেবার মত দুঃসাহস দেখাচ্ছে। আর গোমরাহীর অতলে যাচ্ছে তলিয়ে।
কোন কিতাবের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন জাগলে এ বিষয়ে প্রাজ্ঞদের কাছে এর জবাব জানতে চাইতে হবে। নিজে নিজে সমাধান খুঁজে না পেলে বদনাম ছড়ানোটা আহমকীর নিদর্শন। নিজের অজ্ঞতাকে দলিল নেইয়ের উপর প্রমাণ পেশ করাটা বোকামী ছাড়া আর কী হতে পারে?
ফাযায়েলে আমাল ও আকাবীরে দেওবন্দ এবং হক্কানী ওলামাদের উপর উত্থাপিত অভিযোগের অবস্থা তা’ই। কিছু অতি পন্ডিত লোক কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির তত্বাবধান ছাড়া নিজে নিজে কিতাবগুলো পড়ে। তারপর প্রশ্ন জাগে। নিজে নিজেই এর সমাধান খুঁজে। উত্তর না পেয়ে ছড়াতে শুরু করে এ কিতাব ভুল। শিরকে পূর্ণ।
ডাক্তারী বই নিজে নিজে পড়ে কোথাও প্রশ্ন জাগলে নিজে নিজে খুঁজে উত্তর না পেয়ে যদি উক্ত পাঠক ডাক্তারী ঐ বইকে ভুল সাব্যস্ত করে, তাহলে বিজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে যেমন বিষয়টি চরম হাস্যকর হয়। তেমনি এ অতি পন্ডিত কুরআন সুন্নাহের অনুবাদ পাঠকদের অভিযোগের ধরণ দেখে হাসি পায় বিজ্ঞ আলেমদের।
ফাযায়েলে আমালের উপর উত্থাপিত প্রশ্ন গুলোও তেমনি। যেভাবে প্রশ্ন করা হয়, মনে হয় প্রশ্নকারী বিশাল হাদীস বিশারদ। কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে বিরাট প্রাজ্ঞ লোক। অথচ আমড়া কাঠের ঢেকি । (কিছুটা সংযোজিত ও বিয়োজিত)
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর অমিয় বানী

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. এর অমিয় বানী

১.ইমাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল। যাকে নিজ দাদা [হাম্বল] এর দিকে সম্বন্ধ করে আহমদ ইবনে হাম্বল বলা হয় । ১৬৪ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে বাগদাদ শহরে জন্ম গ্রহণ করেন । শৈশবেই তাঁর পিতার ইন্তেকাল হয়ে যায় । তাই দাদা তাঁর লালন পালন করেন ।এ কারণেই দাদার দিকে নেসবত করে [ইবনে হাম্বল] বলা হয় । আরবের ‘শাইবান গোত্রের সাথে সম্পর্ক রাখতেন ।আর নাজ্জার ইবনে মা’আদ ইবনে আদনানের সূত্রে গিয়ে এই গোত্রের ধারা রসুল স. এর বংশ ধারার সাথে গিয়ে মিলিত হয় । ইমাম সাহেবের পিতা একজন সৈনিক এবং তাঁর দাদা এক সময় ‘সারখস’ এর গভর্নরও ছিলেন । পিতার ইন্তে কালের পর মাতা তার দীনি তবিয়তের ব্যাবস্থা করেন । কুরআন মাজীদ হেফজ করান। ভাষা শিক্ষায় দক্ষ করে তোলেন জীবন যাপনের যাবতীয় আদব ও শিষ্টচার শিক্ষা দেন । ইলমের আগ্রহ এই পরিমাণ সৃষ্টি করেন যে, অধিক মহব্বতের কারণে পরবর্তীতে তাকে নিজেকেই এই ব্যাপারে ভারসাম্যতা রক্ষার ব্যাপারে তারগীব দিতে হয় ।
২.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন , আমি হাদীসের জ্ঞান লাভ করার জন্য সকাল সকাল ঘর থেকে বের হয়ে যেতাম । কোন কোন সময় আম্মাজান আমার জামার আচল ধরে বলতেন, একটু সকাল ত হতে দাও । কমপক্ষে ফজরের আজানটা হোক।
৩.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. ষোল বছর বয়সেই ইলমে হাদীসের অন্বেষণ শুরু করেন । ইমাম মালেক রহ. এর ইন্তেকালের পর হাদীস শরীফের সবচেয়ে বড় দরসগাহ ছিল ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এর দরসগাহ । যিনি ইমাম আবু হানিফা রহ এর গুরুত্বপূর্ণ শাগরিদ ছিলেন । ইমাম সাহেব নিজেই বলেন, আমি সর্বপ্রথম হাদীস শরীফ ইমাম আবু ইউসুফ রহ. এর নিকট থেকে হাসিল করি । তখন আমার বয়স ছিল ষোল বছর । ওই বছরই ইমাম মালেক এবং হাম্মাদ ইবনে যায়েদ ইন্তেকাল করেন ।
৪.ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, "রাই" -এ হযরত যারীদ ইবনে আব্দুল হামীদের কাছে যেতে চেয়েছিলাম । ওই সফরের জন্য পঞ্চাশ দিরহাম প্রয়োজন ছিল । কিন্তু আমার নিকট কিছুই ছিল না । আমার সাথীরা চলে গেল আর আমি থেকে গেলাম ।

ইমাম শাফেয়ী রহ. এর অমিয় বানী

ইমাম শাফেয়ী রহ. এর অমিয় বানী

১.ইমাম শাফয়ী রহ. এর বংশ ধারাবাহিকতা ।
আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস ইবনুল আব্বাস ইবনে উসমান ইবনে শাফি’ ইবনুস সায়েব ইবনে উবাইদ ইবনে আবদ ইয়াজিদ ইবনে হাশেম ইবনুল মুত্তালিব ইবনে আব্দুল মানাফ ।
আবদে মানাফের সূত্র ধরে ইমাম শাফেয়ীী রহ. এর বংশধারা গিয়ে রসুল স. এর সাথে মিলিত হয় ।
ফায়দা : মুত্তালিব ও হাশেম এরা উভয় ছিলেন আবদে মানাফ এর সন্তান ।তাঁরা উভয়ে পরষ্পর আপন রক্তেরভাই ছিলেন । হাশেম মদীনার এক নারীকে বিবাহ করেন ।তার ঘর থেকে একটি সন্তান জন্ম নিল সেই বাচ্চার নাম রাখা হলো “শাইবাতুল হামদ”।এই বাচ্চাটিই অবশেষে আব্দুল মুত্তালিব নামে খ্যাতি লাভ করেছে এবং তিনিই ছিলেন রসুল স. এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব ।
যার মূল ঘটানা হলো এ রূপ যে , হাশেম ব্যবসার উদ্যেশ্যে সিরিয়ায় যান এবং সেখানেই ইন্তিকাল করেন । হাশেমের ভাই মুত্তালিবের এই চিন্তা আসে যে, আমার ভাতিজা “শাইবাতুল হামদ” মদীনা মুনাওয়ারায় রয়েছে ।তাকে মক্কা মুকাররমায় নিয়ে আসব যাতে নিজ খান্দানে তার লালন পালন হয় । শাইবাতুল হামদ তখন সমঝদার বালক । তাই তার মা তাকে চাচার সাথে পাঠিয়ে দেন । এই মুত্তালিব যখন নিজ ভাতিজা “শাইবাতুল হামদ” কে নিজের সওয়ারির পেছনে বসিয়ে মক্কায় নিয়ে আসেন তখন কেও কেও বলে উঠল এটি আব্দুল মুত্তালিব অর্থাত মুত্তালিবের দাশ । এভাবেই তার এই নাম প্রসিদ্ধ হয়ে পড়ে আর কেও কেও বলেছে মুত্তালিব যেহেতু নিজের ভাতিজা “শাইবাতুল হামদ” কে লালন পালন করছেন তাই তার প্রতি তার অনুগ্রহের কারণে তাকে “আব্দুল মুত্তালিব” বলা হতো কারণ জাহেলিয়াত যুগে এধরনের লালন পালনের ক্ষেত্রে এই উপাধিই প্রসিদ্ধ ছিল ।
টীকা: এখান থেকে নিয়ে সবগুলো বিষয় ও বানী আল্লামা হাফেজ ইবনে হাযার আসকালানী রহ. এর কিতাব “তাওয়ালাত তাসীস লি মাআলী মুহাম্মদ আবনে ইদরীস” থেকে গৃহিত ।
২.ইমাম শাফী রহ.১৫০ হিজরীতে [৭৬৭ ঈসায়ী] মিসরের আসকালান অঞ্চলের ‘গুজ্জা’ নামক এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । [১৫০ সেই ঐতিহাসিক হিজরী সাল, যে সালে ইমাম আবু হানীফা রহ. ইন্তেকাল করেছিলেন । দুই বছর বয়সেই তার মাতা তাকে তার আসল খান্দান মক্কা মুকাররমায় নিয়ে আসেন । যেখান থেকে তিনি ইলমে দ্বীন হাসিল করতে শুরু করেন । সতের বছর বয়সে তিনি হুযাইল ও আরবের বিভিন্ন গোত্রের নিকট যান যেন তাদের কাছ থেকে আরবী ভাষার গভীর পাণ্ডিত্য হাসিল করতে পারেন । ১৭০ হিজরীতে তিনি ইমাম মালেক রহ. এর কাছ থেকে শিক্ষা-দ্বীক্ষা লাভ করেন । ১৮০ হিজরীর শুরুতে তিনি ইয়ামান সফর করেন । এরপর ইরাক গিয়ে ইমাম আবু হানিফা রহ. এর বিশেষ শাগরিদ ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আশ-শায়বানীর নিকট ইলম অর্জন করেন। সেখান থেকে মিসর চলে যান। যেখানে মানুষ ইমাম শাফেয়ী রহ.- এর ইলম ও ফেকাহ কে ব্যাপক ভাবে গ্রহণ করে । ১৯৭ হিজরীতে আবার বাগদাদ ফিরে আসেন । এখানে এক বছর থাকার পর ১৯৮ হিজরীতে আবার মিসরে ফিরে যান । এক বছর পর আপন দেশ মক্কা মুকার্রমায় সফর করেন । এরপর ১৯৯ হিজরীতে মিসর ফিরে এসে এখানে থাকতে শুরু করেন । এভাবে ২০৪ হিজরীতে [৮২০ ঈসায়ী] মিসরেই এই সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় ।
৩.ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, আমি সাত বছর বয়সেই কুরআন মাযীদ মুখস্ত করে নিয়েছিলাম আর দশ বছর বয়সে মুয়াত্তা মুখস্থ করে ফেলেছিলাম ।
৪. ইমাম সাহেব বলেন , বাচ্চা বয়সে যদি উস্তাদ কাউকে কোন শব্দ মুখস্থ করাতেন তাহলে তা আমার মুখস্ত হয়ে যেত । বালক হওয়ার পর আমি বেদুইন এলাকায় গিয়েছি । সেখানের হুযাইল গোত্রে আমি তিন বছরে আরবি ভাষা ও সাহিত্য শিখেছি । [ কুরআন হাদীসের অর্থ ও ব্যাখ্যা যথযথভাবে বুঝার জন্য আরবি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন করা কত জরুরী বিষয় ইমাম সাহেবের এই উক্তি থেকে তা অনুমান করা যায়। নিজে আরবের কুরাইশ বংশের লোক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কত গুরুত্বের সাথে এই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছেন ।] ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শাইবানী রহ. বলেন, আমি উত্তরাধিকার সূত্রে ত্রিশ হাজার দীনার পেয়েছিলাম যার অর্ধেক আমি খরচ করি আরবী ভাষা ও কাব্য শেখার পেছনে । আর বাকি অর্ধেক ব্যয় করি হাদীস ও ফেকাহ শেখার পেছনে । (বুলুগুল আমানী [শায়েখ মুহাম্মদ যাহেদ কাউসারী],পৃ:৬)

ইমাম মালেক রহ. এর অমিয় বানী

ইমাম মালেক রহ. এর অমিয় বানী

১.ইমাম মালেক রহ.-এর পর দাদা হযরত আবু আমের রা. সাহাবী ছিলেন । তার দাদা মালেক ইবনে আবু আমের তাবেঈ আলেমগণের মধ্য হতে ছিলেন । যে কয়জন ব্যাক্তি হযরত উসমান রা. এর গোছল ও দাফনের কাজে অংশ নিয়েছিলেন তিনি তাদের মধ্য হতে ছিলেন । ইমাম মালেক রহ. এর পিতা ছিলেন ব্যবসায়ী । তবে চাচা আবু সুহাইল নাফে’ ছিলেন আলেমদের মধ্য হতে এবং মুয়াত্তায় তার রেওয়ায়েত রয়েছে । ইমাম মালেক রহ. কে ‘ইমামু দারিল হিজরা’ এবং ‘ইমামু আহলিল মদীনা’ ও বলা হয় ।আর এই বিষয় টি প্রসিদ্ধ যে ,হযরত আবু হুরায়রা রা. এর এক হাদীসে যে বিদগ্ধ আলেমের কথা বল হয়েছে এর দ্বারা উদ্দেশ্য ইমাম মালেক ই । হাদীসটি মুয়াত্তা ইমাম মালেক , মাসনাদু আহমাদ , জামে তিরমিযী ও সুনানে নাসায়ীতে রয়েছে । এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, সেই সময় অতি নিকটে যে লোকেরা নিজেদের বাহন ও উটে চড়ে দীরঘ সফর করে ইলমের সন্ধানে বের হবে । তখন তারা মদীনার আলেমের চেয়ে বড় আর কোন আলেম পাবে না ।
২.ইমাম মালেক রহ. তুলনামূলক ভাবে কিছুটা খাটো ছিলেন । মাথা ছিল বড় । গায়ের রং ছিল ধুসর । কান ছিল বড় । দাড়ি ঘন ছিল । মোচ রাখার অভ্যাস ছিল । বরং মোচ কামানোকে মাকরুহ মনে করতেন । একবার এক লোককে দেখলেন যে , সে তার মোচ এবং মাথার চুল উভয় কামিয়ে ফেলেছিল তখন তিনি তাকে বললেন, যদি সয়তান তোমাকে ধরে শাস্তি দিত তাহলে এটাই দিত যা তুমি নিজের সাথে করেছ । দাড়ি-মোচ সব গায়েব করে ফেলেছ । বি.দ্র: হাদীস শরীফেও মোচ কামানোর নির্দেশ দেয়া হয়নি বরং ছোট বা কমানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে ।
৩. ইমাম মালেক রহ. উন্নত পোশাক পরিধান করতেন এবং মূল্যবান সুগন্ধি ব্যাবহার করতেন । তিনি বলতেন, বিনয় ও তাকওয়া দীনের ক্ষেত্রে হওয়া চাই । বাহ্যিক পোষাক-আশাকের ক্ষেত্রে নয় । খাবারের মধ্যে গোশত এবং কলা প্রিয় ছিল । তিনি বলতেন, এই ফলে মাছি বসে না । গরমকালে ওঐ শরবত পছন্দ করতেন যার মধ্যে খেজুর মিশানো থাকত । আর শীত কালে পানির সাথে মধু মিশিয়ে পান করতেন । টীকা: অনেক উলামা ও মাশায়েখ উন্নত পোষাক এই জন্য পরিধান করেন যে, মানুষ তাদেরকে দেখে যেন ফকীর-মিসকিন ও পার্থনাকারী মনে না করে ।
৪.নিজের যুগের বৈরাগ্যবাদী এ দুনিয়া ত্যাগী বুযুর্গ আব্দুল্লাহ আল-ওমারী একবার ইমাম মালেক রহ. এর কাছে পত্র লিখেন । যার মধ্যে তিনি তাকে মানুষের সাথে মেলামেশা এবং দুনিয়া বিমুখতা ও ইবাদতের উপর উদ্বুদ্ধ করেছেন । তখন ইমাম মালেক রহ. এর জবাবে লিখেছেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা যেমনিভাবে বান্দাদের মাঝে রিযিক বন্টন করেছেন অনুরূপভাবে নেক আমলও বন্টন করে দিয়েছেন । কারও নামাজে এত তৌফিক হয় রোজার যা হয় না । কারও দান-সদকা করার বেশ তাওফীক হয় কিন্তু নফল রোজার তৌফিক হয় না ।কারও জিহাদের প্রতি এমন আগ্রহ থাকে, নফল নামাযের প্রতি যেমনটি থাকে না । আর দ্বীনি আমলের প্রচার ও প্রসার সমস্ত নেক আমলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদাত । আল্লাহ তাআলা আমাকে যে ইবাদতের তৌফিক দিয়েছন তাতে আমি সন্তুষ্ট আছি।আমার ধারণা যে, আমর এই ইবাদাত আপনার ইবাদতের চেয়ে কম মর্যাদার নয় । আর আমরা সবাই আল্লাহ কাছে প্রতিদান প্রত্যাশী । আল্লাহ তাআলা যাকে যেই নেক আমলের তৌফিক দিবেন সেটার উপর আমাদের সন্তুষ্ট থাকা ওয়াজিব।”
.......ওয়াস সালাম ।

শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৬

ইমাম আজম আবু হানিফা রহ. অমিয় বানী

ইমাম আবু হানিফা রহ.

১. ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন , কোন মাসালায় যদি রসূলুল্লাহ (স: )এর হাদীস( (সহীহ হতে হবে কুরআন বা অন্য কেন হাদীসের বিপরীত হবে না )পাওয়া যায় তাহলে তো আমরা সানন্দে তা গ্রহণ করে নেই । আর যদি কোন মাসালার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম থেকে একাধিক মত পাওয়া যায় তাহলে আমরা সেগুলোর মধ্য হতে একটি মত গ্রহণ করি । তাঁদের মত গুলোকে সম্পূর্ণ এরিয়ে যাই না । তবে তাবেঈনদের [ ইমাম আবু হানীফা রহ. এর সমসাময়িক উলামাদের] একাধিক মত পাওয়া যায় তা হলে সে ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মত ব্যক্ত করি ।

২.ইমাম আবু হানিফা রহ: বলেন, কুরআন হাদীস ও সাহাবায়ে কেরাম রা. এর ইজমা'র বিপরীত কোন ব্যক্তির জন্য নিজের মত পেশ করার বৈধতা নেই ।হাঁ ,যেসব মাসআলার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে সেক্ষেত্রে আমরা তাঁদের উক্তিগুলোর মধ্য হতে সেই উক্তিটিই গ্রহণ করি যা কুরআন হাদীসের অধিক নিকটতর। আর এটাই ইজতেহাদের ক্ষেত্র ।

৩.ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেন যদি দীনের ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার ভয় না হতো তাহলে আমি কখনও ফতোয়া দিতাম না । যেসব বিষয়ের কারণে জাহান্নামে যাওয়ার আশংকা হতে পারে সেগুলোর মাঝে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো "ফতোয়া"।

৪.ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেন, যখন থেকে আমার বুঝ এসেছে , কখনও আমি আল্লাহ তাআলার উপর দুঃসাহসীকতা দেখাইনি । [ অর্থাৎ মাসআলা বলে আল্লাহ তাআলা ও তার রসুলের দিকে নেসবত করিনি ।]

৫.ইমাম আবু হানিফা রহ. যদি কোন মাসআলায় আটকে যেতেন এবং সমাধান না পেতেন তখন তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে বলতেন ,"এটা আমার কোন গুনাহের কারণে হয়েছে ।" অতপর ইস্তেগফার শুরু করে দিতেন । আর অধিকাংশ সময় অযু করে দাঁড়িয়ে দু'রাকাত তাওবার নামায পড়ে দিতেন ।এতে মাসালার সমাধান হয়ে যেত ।তখন তিনি বলতেন ,এটা এক প্রকারের সুসংবাদ । আমি আশাবাদী হতাম যে আমার তাওবা কবুল করা হবে এবং মাসআলা বুঝে এসে যাবে । বিখ্যাত বুযুর্গ ফুযাইল ইবনে আয়ায রহ. যখন ইমাম আবু হানিফা রহ. এর এই আমলের ব্যাপারে জানতে পারলেন তখন কাঁদতে আরম্ভ করলেন এবং বললেন ," আল্লাহ তাআলা আবু হানিফার রহ. এর উপর রহম করুন " তার গোনাহ অনেক কম ।[ তাই নিজের গোনাহ ও দুর্বলতা তিনি অনুভব করতে পারতেন ] কিন্তু অন্যদের তো এই অনুভুতিটুকু হয় না । কারণ তার গোনাহ তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে ।
৬.ইমাম আবু হানিফা রহ. পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন । ভুলক্রমে একটি শিশুর পায়ে তার পা লেগে গেল । তিনি তা দেখতে পাননি । ওই শিশু বলে উঠল, হে শায়েখ ! আপনি কি কেয়ামত দিবসের বদলাকে ভয় পান না ? এ কথা শুনে ইমাম সাহেব হুশ হারিয়ে ফেল্লেন । যখন হুশ ফিরে পেলেন তখন তাকে বলা হল, এই একটি কথার এমন প্রভাব ? তিনি বললেন , আমি আশংকা করছি যে, এ কথা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তার অন্তরে ঢেলে দেওয়া হয়েছে ।
৭.ইমাম আবু হানিফা (রা.) -এর বিরুদ্ধাচারী এক ব্যাক্তি একবার তর্ক করতে গিয়ে ইমাম সাহেব কে লক্ষ্য করে বলল , হে বিদআতী ! হে বে-দ্বীন ! ইমাম সাহেব তাকে বললেন , ' আল্লাহ তাআলা তোমাকে ক্ষমা করুন । আল্লাহ তাআলা জানেন, তুমি ভুল বলেছ । মহান আল্লাহর পরিচয় পাওয়ার পর এখন আর কারও পরোয়া করি না । হ্যাঁ, সে মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা পার্থনা করি এবং তার শাস্তিকে ভয় পাই । ' তখন ওই ব্যক্তি বলল ,আমাকে ক্ষমা করে দিন । তখন ইমাম সাহেব বললেন , কোন অজ্ঞ লোক আমার ব্যাপারে কোন কথা বলেছে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি । কিন্তু যে আলেম আমার ব্যাপারে এমন কথা বলেছে যা আমার মধ্যে নেই । তাহলে ব্যাপারটি জটিল হয়ে দাড়ায় । কারণ ইলামায়ে কেরামের গীবতের প্রভাব পরেও বাকি থাকে ।
৮.ইমাম আবু হানিফা রহ. এর সামনে যদি কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তির উক্তি বর্ণনা করত [যে ইমাম সাহেবদের সমালোচনামূলক কোন কথা বলোছে ] তখন তিনি তাকে থামিয়ে দিতেন এবং বলতেন, মানুষের অপছন্দনীয় কথাগুলো বর্ণনা করা ছেড়ে দাও। যে আমাদের ব্যাপারে কোন ভুল কথা বলেছে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করুন। আর যে আমাদের ব্যাপারে কোন ভাল কখা বলেছে আল্লাহ তাআলা তার প্রতি রহম করুন। [মানুষের উক্তি বর্ণনার পরিবর্তে ] আল্লাহ তাআলার দীনের জ্ঞান অর্জন কর। মানুষের কথা বাদ দাও। মানুষকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। হতে পারে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তোমাদের মুখাপেক্ষী বানিয়ে দিবেন।
৯.ইমাম আবু হানীফা রহ. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে প্রখ্যাত তাবেঈ আলকামা (রহ.) শ্রেষ্ঠ নাকি আসওয়াদ রহ. শ্রেষ্ঠ ? উত্তরে ইমাম সাহেব বল্লেন, আল্লাহর সপথ ।আমি তো নিজেকে এর যোগ্য মনে করিনা যে আমি আমি তাঁদের নাম আমার মুখে আনব ।আমি তাঁদের একজনকে অপরজনের উপর কিভাবে প্রাধান্য দিতে পারি ?
১০.ইমাম সাহেবকে বলা হলো যে, মানুষ তো আপনার ব্যাপারে কথা বলে । [অর্থাৎ আপনার প্রশংসামূলক কথা বলে ] কিন্তু আপনি তো সেগুলোর উপর কোন কিছু বলেন না । তখন তিনি বললেন ,"এটা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যকে চান নিজের অনুগ্রহ দ্বারা ভূষিত করেন ।"
১১.ইমাম আবু হানিফা রহ. এর ব্যবসা ছিল বেশ বিস্তৃত । ব্যবসার যে লভ্যাংশ তিনি লাভ করতেন তার বিরাট একটা অংশ তিনি নিজের মাসায়েখ মাহাদ্দিসদের খেতমতে পেশ করতেন এবং বলতেন , আপনারা আপনাদের প্রয়োজনে এগুলো খরচ করুন । আর কেবল আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করুন । কারণ আমি আমার সম্পদ থেকে কিছুই দেইনি । বরং এগুলো আল্লহ তাআলার সম্পদ এবং তাঁর অনুগ্রহ ।যা আল্লাহ তাআলা আমার হাত দিয়ৈ চালু করেছেন ।
১২.ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেন যদি আল্লাহ তাআলার ভয় না হতো এবং ইলম বিলুপ্ত হবার আশংকা না করতাম তাহলে আমি কাউকে ফতোয়া দিতাম না । সে তো [ফতোয়া জিজ্ঞেসকারী ] আরাম ভোগ করবে আর গোনাহের বোঝাটা থাকবে আমার মাথার উপর ।
১৩.ইমাম আবু হনিফা রহ. বলেন , আমি কখনও কোন মন্দের জবাব মন্দ দিয়ে দেই নি ।আমি কখনও কারও প্রতি অভিসম্পা করিনি আমি কোন মুসলমান অথবা জিম্মি কাফেরের উপর জুলুম করিনি আমি কখনও কাউকে ধোকা দেইনি । এবং কারও সাথে বিশ্বাসঘাতকাতা করিনি ।
১৪.ইমাম আবু হনিফা রহ. বলেন যে সময় হওয়ার পূর্বেই বড় হতে চায় সে লাঞ্ছিত হয়ে যায় ।
১৫.ইমাম আবু হানিফা রহ বলেন , যদি উলামায়ে কেরাম যদি আল্লাহওয়ালা না হন তবে দুনিয়া ও আখিরাতে কোন আল্লহ ওয়ালা নেই ।
১৬.ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন যে ব্যক্তি তে তার ইলম হারাম বিষয় ও বস্তু থেকে বাধা না দেয় সে ধ্বংসের মধ্যে রয়েছে ।
১৭.এক ব্যক্তি ইমাম আবু হানিফা রহ. কে জিজ্ঞেস করল , দ্বীনের জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি অধিক সাহায্যকারী ? তিনি বললেন, 'একাগ্রতা অবলম্বন করা ।' সে আবার প্রশ্ন করল,একাগ্রতা হাসিল হবে কিভাবে ? তিনি বললেন,মেলামেশা ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় কমিয়ে দেওয়ার দ্বারা ।সে আবার বলল, এটা কিভাবে কম হবে ? তিনি বললেন, যে বস্তু যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি নিবে না ।
১৮.ফরজ নামায আদায়ের পর কতক লোক ইমাম সাহেবকে মাসআলা জিজ্ঞেস করল । ইমাম সাহেব সেগুলোর উত্তর দিলেন । তখন এক ব্যক্তি অভিযোগের স্বরে প্রশ্ন করে বসল, বুযুর্গগণ কি এই সময়ে ' উত্তম কথা' ছাড়া অতিরিক্ত কোন কথা বলতে নিষেধ করতেন না ? ইমাম সাহেব বললেন, ' হালাল-হারামের বিধান বর্ণনা করে দেওয়ার চাইতে উত্তম কথা আর কি হতে পারে ? আমরা মহান আল্লাহর অবাধ্যতা হতে তাঁর নিকট আশ্রয় কামনা করি আর মানুষকেও তা থেকে বাঁচাই ।
১৯.এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির সুপারিশ নিয়ে এসে বলল ,আপনি আমাকে ইলম শিখিয়ে দিন।ইমাম সাহেব বললেন , এভাবে ইলম অর্জন করা যায়না । আল্লাহ তাআলা উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে নিয়েছেন যে, তাঁরা যেন মানুষের কাছে ইলম বর্ণনা করে এবং তা না লুকায় । অতঃপর বল্লেন, আলেম একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইলম শিক্ষা দেয়। তারা বিশেষ রহস্যজ্ঞানী হয় না ।
২০. ইমাম সাহেব তার এক শিষ্যকে বললেন, আমি যখন চলন্ত অবস্থায় হাঁটতে থাক অথবা মানুষের সাথে কথা বলতে থাকি কিংবা সওয়ার অবস্থায় থাকি বা বিশ্রাম নেই এই সময়গুলোতে আমার কাছ থেকে দ্বীনের কথা [মাসআলা-মাসায়েল ] জিজ্ঞেস করবে না । কারণ এই সময়গুলোতে মানুষের চিন্তা বিক্ষিপ্ত থাকে ।
২১. এক ব্যক্তি ইমাম সাহেবকে হযরত আলী রা. ও হযরত মুয়াবিয়া রা. এর পরষ্পর মতানৈক্য এবং তাদের মধ্যকার 'সিফফীন যুদ্ধে' নিহিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল । তিনি উত্তরে বল্লেন , যখন আল্লাহ তাআলা আমাকে নিজের সামনে দাঁর করাবেন তখন আমাকে তাদের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করবেন না ।হাঁ, যেসব বিষয়ের দ্বায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করা হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে । তাই সেসব বিষয়ে লিপ্ত থাকাটাই আমি পছন্দ করি ।[যেগুলোর ব্যাপারে কেয়ামতের দিন আমাকে প্রশ্ন করা হবে ।]
২২.ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন ,আমি ওই সব লোকদের ব্যাপারে খুবই বিস্বয় বোধ করি , যারা দীনের ব্যাপারে অনুমান-আন্দায করে কথা বলে দেয় ।
২৩. ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন , যে ব্যক্তি দুনিয়ার উদ্দেশ্যে ইলম শিখে সে ইলমের বরকত থেকে বঞ্চিত হয় । ইলমের গভিরতা সে লাভ করতে পারে না এবং আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ তার ইলম দ্বারা উপকৃতও হয় না । আর যে দীনের উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করে, ইলমের বরকত সে লাভ করতে পারে । ইলমের গভিরতা ও পরিপক্বতা সে লাভ করতে পারে । আর ইলম অন্বেষণকারীরাও তার ইলম দ্বারা উপকৃত হয় ।
২৪. একবার ইমাম সাহেব রহ. বিখ্যাত বুজুর্গ হযরত ইবরাহীম ইবনে ইদহাম রহ. কে বললেন , হে ইবরাহীম! আপনার তো ইবাদাতের বিরাট অংশ নসীব হয়েছে । আপনি ইলমের প্রতিও লক্ষ্য রাখুন । কেননা ইলমেদীন হলো ইবাদাতের বুনিয়াদ বা ভিত্তি । আর ইলমেদঅন দ্বারা দীন ও দুনিয়ার সকল বিষয় সঠিক পন্থায় পরিচালিত হয় ।
২৫. ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন , যে ব্যাক্তি হাদীস পড়ে কিন্তু তার অর্থ বুঝে না সে হল ঐ ব্যাক্তির ন্যায় যে বহু ঔষুধ নিজের কাছে জমা রেখেছে । কিন্তু সেগুলোর ব্যাবহার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সে যথাযথ অবগত নয় ।
২৬. ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, যখন দুনিয়াবী কোন কাজ সামনে আসে তখন কাজ আগে সমাধান করে নাও । তারপর খানা খাও ।
২৭. সমকালীন রাষ্টপ্রধান খলীফা মানসুর ইমাম সাহেবকে লক্ষ করে বলল , আপনি আমাদের কাছে কেন আসেন না ? ইমাম সাহেব বললেন , আমার নিজের কোন জিনিষের ব্যাপারে আপনার ভয় নাই । যদি আপনি আমাকে কাছে টেনে নেন তবে আমি ফেতনায় পড়ে যাব । অতপর যখন বিতাড়িত করে দিবেন তখন লাঞ্ছিত হয়ে যাব ।
২৮.তৎকালীন কুফার গভর্ণরও ইমাম সাহেব কে এ ধরণের কথা বলেছেন , তখন তিনি এর জবাবে বলেছেন রুটি টুকরো, পানির গ্লাস ও চামড়ার পোশাক সেই বিলাসী জীবন থেকে উত্তম, যার পরে [দুনিয়া ও আখিরাতে] লাঞ্ছিত হতে হয় ।
২৯. ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, যে পরকালের শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে চায় তার জন্য দুনিয়ার কষ্ট কোন কষ্টই নয় । আর যে নিজের আত্মাকে সসম্মানে রাখে [অর্থাৎ দুনিয়া ও আখিরাতের লাঞ্ছনা থেকে বাঁচতে চায় ] দুনিয়া তার কাছে তুচ্ছ ও অপদস্থ হয়ে হাজির হয়।
৩০. ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন , নিজের জন্য গোনাহের বোঝা আর উত্তরাধিকারীদের জন্য ধন-সম্পদ জমা করো না ।
৩১.ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, হযরত আলী রা. যার সাথেই লড়াই করেছেন তিনি সত্যের উপর ছিলেন । যদি হযরত আলী রা. এর সাথে এসব লড়াই সংগঠিত না হতো তবে বিদ্রোহীদের শরঈ বিধান বুঝে আসত না ।
৩২. ইমাম আবু হানিফা রহ. কে একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করা হয়েছে যখন তিনি এর উত্তর দিলেন তখন প্রশ্নকারী তাকে বলল, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি জীবিত থাকবেন এই শহরের জন্য কল্যাণ আর কল্যাণই বিরাজ করবে । তখন ইমাম সাহেব বললেন, এলাকা খালি হয়ে গেছে তাই আমার কোন খায়েশ ছাড়াই আমাকে ‘বড়’ মনে করা হচ্ছে । কিন্তু এই বড়ত্বটা আমার জন্য বেশ অস্বস্তিকর

৩৩. প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত আ’মাশ রহ. এর নিকট কয়েকটি মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলো । ওই মজলিসে ইমাম আবু হানিফা রহ.ও উপস্থিত ছিলেন । আমাশ রহ. ইমাম সাহেব কে বললেন , আপনি মাসআলাগুলোর উত্তর দিন । ইমাম সাহেব মাসআলা গুলোর উত্তর দেয়ার পর আ’মাশ রহ. তাকে বললেন, আপনি মাসআলাগুলোর উত্তর কোথ্থেকে সংগ্রহ করেছেন ? তিনি উত্তর দিলেন, ওই সব হাদীস থেকে যা আমি আপনার কাছ থেকে বর্ণনা করেছি । অতঃপর তিনি হাদীস গুলো তাকে শুনিয়ে দিলেন । তখন আ‘মাশ বললেন , যে হাদীসগুলো আমি আপনাকে একশ দিনে শোনিয়েছিলাম, আপনি কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে সেগুলোর সারাংশ শুনিয়ে দিলেন ! আমার এই ধারণা ছিল না যে, আপনি হাদীস গুলোর উপর এই ভাবে গবোষণা করবেন । অতঃপর আমাশ রহ. বললেন হে ফুকাহায়ে কেরাম ! আপনারা হলেন ডাক্তার । আর আমরা ত শুধু ঔষুধ বিক্রেতা । আর হে আবু হানীফা ! আপনি তো উভয়টাই রপ্ত করে নিয়েছেন । অর্থাত আপনার কাছে হাদীসও রয়েছে । ফেকাহ ও রয়েছে । ]